শনিবার, এপ্রিল ০৬, ২০২৪

দীর্ঘ আট বছর পর আমার স্ত্রী রিনার আজ বাচ্চা হয়েছে।

 কখনো ছেড়ে যেও না

ইয়াছিন আরাফাত 

দীর্ঘ আট বছর পর আমার স্ত্রী রিনার আজ বাচ্চা হয়েছে। রাত তিনটার ঠিক কিছু সময় আগে আমার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতরাতে থাকে। আমি তার অবস্থা দেখে পাশের বাড়ির আয়েশা ভাবিকে ডেকে এনে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে এক মুহূর্তও দেরী না করে ধাত্রীর খোঁজে বেড়িয়ে পড়ি। প্রায় তিন কিলোমিটার দৌড়ে আমাদের এলাকার সবচেয়ে ভালো ধাত্রীর কাছে পৌঁছে একটা ডাক দিলাম। আমার কাছে ডাক টা সাধারণই ছিল কিন্তু হঠাৎ ডাক টা এমন বড় হয়েছে যে,ঐ ডাকে ধাত্রীর ঘুম সহ পাশের দশ পরিবারের ঘুমও ভেঙ্গে গেছে। আমার অবস্থা দেখে ধাত্রী একটুও দেরী না করে আমার সাথে এসে স্ত্রীকে ভালো ভাবে দেখে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন। ততক্ষণে দূরের কোন এক মসজিদ থেকে কানে ফজরের আযান ভেসে আসছিল। বুঝলাম সকাল হতে আর দেরী নাই। তাড়াহুড়ো করে স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছনোর পরপর ডাক্তার এসে সবাইকে বের করে দিলেন। দুই ঘন্টা পর কালো বর্ণের এক সুন্দরী নার্স জানালেন আমি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছি। মা এবং সন্তান দুজনই সুস্থ আছেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। শুনে মনটা খুশিতে ভরে গেল এবং একটা অদ্ভুত রকমের অনুভূতি নাড়া দিতে লাগল এবং চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল সবাই শোন আমিও সন্তানের বাবা হয়েছি।  




এই আট বছরের সংসার জীবনে আমার স্ত্রী রিনা এবং আমাকে অনেক ধরনের বাজে কথা ধৈর্য ধরে শুনতে হয়েছে। আমার স্ত্রীকে বলত, তুই কি একটা হিজড়াকে বিয়ে করেছিস? বাচ্চা হয় না ক্যা? এই হিজড়ার সাথে তুই এজন্য এতোদিন সংসার করতেছিস। অন্য কেউ হলে বিয়ের পরের দিনই চলে যেত। আজকাল তোর মতো সরল মেয়ে পাওয়া দুষ্কর। তাই বলে সারাজীবন ওর মত হিজড়াকে সেবা করে নিজের ফুলের মতো জীবনকে নষ্ট করে দিবি? আমাকে বলত, তুই তো একটা বাজা মেয়েকে বিয়ে করেছিস। সেই কখনো তোকে বংশের প্রদীপ উপহার দিতে পারবে না। আমরা দুজন এসব কথার কোনো উত্তর দিতাম না, চুপ হয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে সহ্য করতাম। তারাও কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না দেখে বলা শেষ হলে মুখে বিরক্তির চাপ নিয়ে এমনি চলে যেতো । এই হলো সরাসরি বলা কথা আর বাইরের আলাপ আলোচনার কথা না'ই  বললাম। 


ভিতরে গিয়ে আমার কন্যা সন্তানকে কুলে নিয়ে একনজর থাকিয়ে ছিলাম। সেই যেন তার মায়ের মতো হয়েছে, তার চোখ, নাক, মুখ যেন তার মায়ের ই প্রতিচ্ছবি। ডাক্তার বলল, দুপুরের পর বাড়িতে নিয়ে আসতে পারব। দুইটা বাজার ঠিক কিছু সময় পরেই চলে আসার জন্য বের হয়েছি এমন সময়ে পাশের একটা রুম থেকে প্রচন্ড রকমের চেচামেচির শব্দ কানে আসছিল। এমন সময় কি হয়েছে জানতে চাইলে অপরিচিত মধ্য বয়সী লম্বা এক লোক বলতে শুরু করল, এই মহিলাকে গতকাল এক ভদ্রলোক হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। ভদ্র লোক বলতেছে এই মহিলাকে সেই চিনে না শুধু মানবিকতার কথা চিন্তা করেই রাস্তার পাশে জ্ঞানহীন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, প্রাণ বাঁচাতে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। উনি এখন পুরোপুরি সুস্থ হওয়াই তাকে সকলেই বাড়িতে চলে যেতে বলা হয়েছিল কিন্তু উনি এখন পযর্ন্ত কোথাও যায়নি। উনি মুখ দিয়ে শুধু একটা কথা বলছে, আমি আমার ছেলেকে ছাড়া কোথাও যাব না। ভদ্র লোকের কথা শেষ হলে সেই তার কাজে চলে যায়। কিন্তু ছোট বেলায় বাবা-মা হারানো আমার চোখে পানি আর রইল না, সামান্য কিছু গড়িয়ে মাটিতে পড়তে দেরী হলো না। সবার থেকে আলাদা ভাবে রিনা'ই আমাকে সবচেয়ে বেশি জানত এবং বুঝত। সেই বলল, নতুন মেহমানের সাথে নতুন মেহমান কেমন হয় বল তো? 


আমি বললাম, তুমি আমার মনের কথায় বলেছ। মহিলাটি প্রথম দিকে আসতে না চাইলেও যখন বললাম,আপনার ছেলেকে না পাওয়া পযর্ন্ত অন্তত আমার কাছে থাকেন? আমিও আপনার ছেলে। সেই একটু ভেবে আসতে রাজি হল। আমাদের ছোট সংসার রিনা আমি ছাড়া কেউ নেই। এখন নতুন অতিথির সাথে নতুন অতিথি নিয়ে বাড়িতে আসলাম। আমরা দুই বোন এক ভাই ছিলাম। আমার বয়স হয়তো তখন এগারো কাছাকাছি ঠিক মনে নেই। বাবা এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। এরপর মায়ের হাতেই মানুষ। মায়ের হাতে বড় হওয়ার মধ্যে একটা আলেদা প্রশান্তি আছে। যেমন- যখন শাসন করেন কঠোর হাতে দমন করেন, আবার যখন আদর করেন পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা বিলিয়ে দেন। মা দুই বছর আগেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। বোনদের সবার বিয়ে হওয়াই সংসারে আমি আর রিনা ছাড়া কেউ ছিল না। মা আজ বেঁচে থাকলে নাতনি কে কুলে নিয়ে সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতেন। কিন্তু আজ আমার মা নেই। কিন্তু আজ যেন সেই মায়ের অভাব পূরণ হয়ে গেল। 


পরে জানতে পারলাম, মহিলাটি আসলে সুস্থই ছিল।গত পনেরো দিন ধরে ছেলের খোঁজে শহরের পথে পথে খেয়ে, না খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে অজ্ঞান হয়ে রাস্তার পাশে কখন যে পড়ে রইলেন তার সেই খবর নাই। মহিলার নাম শিপা আক্তার। ত্রিশ বছর হলো তার স্বামী দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে স্বর্গে রওনা দিয়েছেন। স্বামীর টাকা পয়সা, অর্থ সম্পদ খুব বেশি না থাকলেও কোনো প্রকার খেয়ে বেঁচে থাকার মতো ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র সন্তান মানিক মিয়াকে শিক্ষিত করার জন্য, মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য আর বিয়ের চিন্তা মাথায় আনেন নি। অনেক মানুষ তাকে আরেকটি বিয়ের  প্রস্তাব দিলেও তিনি অনেক ভালো ভালো সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়ে ছিলেন। সুন্দরী হওয়াই আরো অনেক বেশি দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে,এই ভদ্র সমাজ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। খেয়ে, না খেয়ে সন্তানকে শিক্ষিত করতে চেয়েছি। ছেলেকে যাতে কখনো সমাজের কাছে মাথা নিচু করে চলতে না হয়। হ্যাঁ আজকে আমি সফল তাকে শিক্ষিত করতে পেরেছি কিন্তু সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি নাই মানুষের মতো মানুষ হিসেবে বড় করতে পারি নাই। যে শিক্ষার মধ্যে নীতি, নৈতিকতা নেই, আদর্শ নেই, সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক রক্ষার ও তার দিক নির্দেশনার শিক্ষা নেই সেই শিক্ষা মানুষকে সার্টিফিকেটি শিক্ষিত বানাতে পারে প্রকৃত শিক্ষিত না, মানুস বানাতে পারে মানুষ না। আজ আমি সফল হয়েও ব্যর্থ। আজ আমার কাছে অর্থ সম্পদের অভাব নেই, আমার স্বামী যা রেখে গেছে তা বিক্রি করলে দুইজন সেবিকা রেখে আমার জীবন অনায়াসে পার করে দিতে পারব। কিন্তু যে ছেলেকে শিক্ষিত করার জন্য আমার ভরা যৌবন সন্তানের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলাম আজ সেই আমার কাছে নেই।


শুনছি ঢাকার এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। গত তিন বছর ধরে সেই বাড়ি যায় না, আমার খোঁজখবর নেয় না । তাই সন্তানের খোঁজে শহরে এসেছিলাম, ঠিকানা জানি না,পথে যদি কোথাও দেখা হয়ে যায় এই ভেবে খোঁজতে খোঁজতে কখন যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি তো এমন করিনি। আমি বিয়ে পযর্ন্ত করি নাই এজন্য যে, আমি যাকে বিয়ে করব সেই যদি আমার সন্তানকে তার সন্তানের মতো করে ভালো না বাসে। তখন তার মধ্যে এক প্রকার হীনমন্যতা কাজ করবে, তার কোমল মন  বৈষম্যের শিকার হবে, তার ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে যাবে । আমার সন্তান কে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে চাইনি। হোক না সেটা আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও। তাকে আমি দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করতে দিয় নাই। তাকে আমি অন্য সাধারণ এতিম সন্তানদের মতো করে বড় করি নাই। সেই আমার হৃদয়ের মানিক ছিল, আছে এবং সারাজীবন থাকবে। সাপ যেমন তার মনি হারানোর পর মরে যায়, বাঁচে না। আমিও আমার বুকের মানিক ছাড়া বাঁচতে পারব না। 


আমি বললাম, তাদের সাথে দেখা হলে আপনি কি বলতে চান? আমি শুধু একটা কথা বলব,  

তোমরা বরং আমাকে হত্যা করো,

তবুও কখনো ছেড়ে যেও না। 



                    সমাপ্ত





লেখক: 

শিক্ষার্থী,কবি ও গল্পকার। 

অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

উপ-দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। 

 eashina404@gmail.com



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios:

দৈনিক অনুসন্ধান
সত্যের সন্ধানে বলিষ্ঠ দৈনিক অনুসন্ধান, সত্য প্রকাশে নির্ভীক...