ডি
ভোর্স
![]() |
ইয়াছিন আরাফাত |
আমার নাম লিলি। আমাদের বাড়ি ছোট্ট রূপালি গ্রামে। এখানেই আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। আমার কাছে আমাদের গ্রামের চেয়ে পৃথিবীতে আর কোন সুন্দর গ্রাম নেই। এখানেই রয়েছে বড় খাল এবং খালের দুপাশে চাষাবাদ করার ফসলি জমি একটু পরেই পাহাড়। এখানে সহজে মাছ, মাংস, শাকসবজি নানা ধরনের ফলমূল সহজেই পাওয়া যায়। এইখানে রয়েছে নান্দনিক শৈলীতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী মনরূপা মসজিদ। মসজিদের সামনে বড় পুকুর যেখানে গ্রামের সহজ সরল মানুষ ওযু করে, গোসল করে। পুকুরের চারপাশে রয়েছে নারকেল ও সুপারি গাছ। এখানে আরও রয়েছে রূপালি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রূপালি উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের সামনে বড় খেলার মাঠ। এ যেন স্বপ্নের মতো একটা গ্রাম। এখানেই আমার পড়ালেখা স্বাভাবিক ভাবে চলছিল কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই বিয়ে দিয়ে দিল। আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশী তেমন কাউকে ই দাওয়াত দেওয়া হয়নি। বিয়ের রাতে শুধু নানার বাড়ি থেকে নানা ভাই আসছিল। বিয়ের দিন আসরের পর সাজানোর জন্য পার্লারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার সাথে গিয়েছিল আমার ছোট বোন কারিমা। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির পরিবার আমাকে আর বাবার বাড়িতে আসতে দেয়নি। পার্লার থেকে সোজা শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বিয়ের নেই কোনো উত্তেজনা কিংবা নেই কোনো আয়োজন। আমাকে নিয়ে গিয়ে বসানো হলো একটা রুমে যেখানে একটা থাকার খাট ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যাতে আমার আত্মীয়স্বজন আসলে দেখলে বলতে পারেন। বাড়ি থেকে শুধু মেয়েই দিলেন। মেয়ের সাথে কিছু দিলেন না? শ্বশুরবাড়িতেও তেমন কোনো মেহমান ছিল না। যারা ছিল তারা হলেন আমার স্বামী শফিউলের তিন বোন সুমি,রুমি, সানজিদা,তাদের বাচ্চারা এবং শফিউলের আম্মু।
মেহমানদের উত্তেজনা না থাকলে কি হবে। শফিউলের মায়ের উত্তেজনা ঠিকই ছিল। কিন্তু তা মেহমানদের খুশি করতে নয়। আমাকে কথা শুনানোর জন্য, উত্তেজিত হয়ে বলতেছে চায়ের দোকানদারের মেয়ে আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসে কেমনে?
শফিউলের বোনেরা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল তোমার শাশুড়ি অসুস্থ মানুষ ওনার কথায় কান দিও না। এশার পর আমার বড় ভাই, আমার জেঠাতো ভাইয়েরা আমাকে দেখতে আসেন। শফিউলের বোনেরা ওদের কে রুম দেখাই দেখাই বলতেছে এইরুমে এটা লাগবে ঐ রুমে ঐটা লাগবে একেকজন একেকটা বলতে লাগল । কিন্তু ওনারা শুনতেই আছেন, কিছু বললেন না।
আমার ভাইয়েরা রাতে চলে যাওয়ার পরে আশে পাশের বাড়ি ঘর থেকে অনেকে দেখতে আসল এবং কয়েকটা ভাবি কিছু সস্তা উপদেশও দিয়ে গেল। আমি চুপ করে বসে রইলাম । রাত দশটার পর মানুষের আসা বন্ধ হয়ে গেলে স্বামী রুমে এসে আমার কিছু লাগবে কি'না অসুবিধা হচ্ছে কি'না তা জিজ্ঞেস করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল এবং পাঁচ মিনিট পর ওযু করে ফিরে আসল বলল নামাজ পড়বে। নফল নামাজ। জায়নামাজ বিছিয়ে আমাকে বলল আমার শাড়ির আঁচল যেন জায়নামাজের ওপর দিয়। স্বামীর কথা মতো জায়নামাজের পাশে বসে শাড়ির আঁচলটাকে জায়নামাজের ওপরে বিছিয়ে দিলাম। স্বামী শফিউল নামাজ শেষ করে ওঠলে আমিও নামাজ আদায় করে নিলাম। তারপর অনেকক্ষণ গল্প করে ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে গোসল করে আসলে শফিউলের মেজ বোন শাড়ি পড়িয়ে দিল। সকাল নয়টার দিকে শফিউল রেডি হয়ে কোথায় যেন গেল কিছু বলে যায়নি। আমিও আঁক বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি নাই। দুপুরের পরে আমার ছোট বোনের জন্য জামা নিয়ে হাজির হলেন। বললেন ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিল । ছোট বোনের স্কুল খোলা তাই আসরের পরে তাকে জামা এবং পাঁচশত টাকা দিয়ে গাড়িতে তুলে দিল। আমার সামনে সব ঠিকঠাক ভাবে চলছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমার নামে তাদের মা ও ভাই বোনদের মধ্যে আলোচনা সমালোচনা চলতেছিল। (2)
কিন্তু আমার স্বামী আমাকে কিছু বলত না। আমাকে নিয়ে যে তাদের অনেক সমস্যা তা আমাকে বুঝতে দিত না। কিন্তু আমি একটু একটু বুঝতে পারছিলাম। আমাদের গ্রামের বিয়ের রীতি অনুযায়ী চার দিন পর আমি আমাদের বাড়িতে চলে আসি এবং আব্বু-আম্মু, ভাই-বোনদের জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করি। ভাইদের সাথে তাদের বাড়িতে কৌশলে যৌতুকের যে দাবী করেছে তাতে তারা খুবই অসন্তোষ এবং হতাশা গ্রস্থ। তারা এইসব আচরণ বাড়িতে এসে আমার মা-বাবাকে বলেছে এবং আমি যে চারদিন শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম ঐচারদিন তারা ভালো করে কেউ খেতে পারে নি। যখন আমি বাড়িতে আসলাম এবং তাদের সাথে করা আচরণ এবং আমার সাথে এই চারদিনে যে আচরণ করেছে এইসব শুনে তারা আমাকে আর শ্বশুরবাড়িতে না পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু আমি তারপরও শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য রাজি ছিলাম। কারণ স্বামী শফিউলের মা এবং তার বোনেরা খারাপ আচরণ করলেও তিনি একটুর জন্য হলেও খারাপ আচরণ করে নি। কিন্তু তিনি মা এবং বোনদের প্রচন্ড ভালোবাসতেন এবং তাদের কথা অনুসারে সবকিছু করতেন এবং চলতেন।
কয়েকদিন পর স্বামী এবং তাদের বাড়ির আত্মীয়স্বজন আমাকে নিতে আসেন। তাদের বাড়ি থেকে আমাকে নিতে আসবে শুনে তাদের জন্য বিভিন্ন খাবারের আয়োজন করেন এবং আমার ফুফি ও খালাম্মাদের দাওয়াত করেন। শ্বশুরবাড়ির লোকদের আগে আমার আত্মীয় আগে চলে আসে এবং আমাদের পরিবার থেকে আমাকে আর শ্বশুর বাড়িতে না পাঠানোর পরিকল্পনা শুনে বিরোধীতা করে এবং নিতে আসলে তাদের সাথে দিয়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। কিন্তু আমার পরিবার আত্মীয়স্বজনের কথা না শুনে আমাকে লুকিয়ে রাখে এবং শ্বশুরবাড়ির লোকদের সামনে না যেতে নিষেধ করে। পরিবারের কথা মত আমাকে চাচার বাড়িতে লুকিয়ে রাখে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন আসলে তাদের ভালো ভাবে আপ্যায়ন করেন এবং বিভিন্ন ধরনের খাবার পরিবেশন করেন। খাবার-দাবার শেষ করে আমি রেডি হয়েছি কি'না জিজ্ঞেস করলে আমার পরিবার আমাকে আর তাদের কাছে মেয়ে পাঠাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। এই কথা শুনে শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। পরে আবার সাড়া বাড়ি হৈচৈ শুরু করে দেন। আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এইদিক সেদিক আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেন। কোথাও না পেয়ে আমার আম্মু এবং পরিবারের সদস্যদের সাথে জগড়া শুরু করে দেন। আম্মু বলতেছে যারা কথা দিয়ে কথা রাখে না, যারা কিছু চাইবে না বলে আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে যৌতুকের জন্য অত্যাচার করে, যারা আমার বাড়ির মানুষকে অপমানিত করে, তাদের বাড়িতে আমি আমার মেয়ে দিতে পারি না। যেখানে বিয়ের চারদিনের ভিতরে আমার মেয়ে অস্বস্তি অনুভব করে, যেখানে আমার মেয়ের জীবনের ঝুঁকি রয়েছে সেখানে আমার মেয়ে দিতে পারি না।
সত্যি বলতে বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ির লোকজন যখন আমাকে দেখে তখন তারা কোনো কিছু ছাড়া আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে যায়। তারপরও আমাদের পরিবার থেকে আমাকে তাদের পরিবারে বিয়ে দিতে চাইছিল না। কারণ ইতিমধ্যে আমার জন্য অনেক ভালো ভালো বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল শুধু যৌতুক চাওয়ায় বিয়েগুলো ভেঙ্গে যায়। কিন্তু আমার শ্বশুরবাড়ির পরিবার আমার পরিবার থেকে বিয়ে দিবে না শুনে তারা অনেক জোরাজুরি করে আব্বু-আম্মুকে রাজি করাই শুধু তাদের মেয়েকে সাজিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে। আমার বিয়ে তাদের পরিবারে না দেওয়ার জন্য আমার চাচার পরিবার থেকে অনেক নিষেধ করেছিল। এমনকি আমার মা-বাবাকে পাগল হয়ে গেছেন নাকি বলে গালি দিয়েছিল। কিন্তু আমার মা-বাবা কারো কথা না শুনেই আমাকে শফিউলের সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য রাজি হয় যায়। শফিউলের পরিবারও চালাকি করে আমাকে দেখার পরের দিন তাড়াহুড়ো করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরালোভাবে চেষ্টা করে এবং সফলও হয়। আমাকে বিয়ের পার্লার থেকেই তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অল্প সময়ের ভিতরে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমার পরিবার থেকে তাদের পরিবারে তেমন কিছু দেওয়া সম্ভব হয়নি। তারা চাইনিও। তারা না চাইলেও আমাদের পরিবার থেকে ফার্ণিচার, সমাজের মানুষকে খাওয়ানো সব করত কিন্তু সময় সুযোগের কারণে করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে করার ইচ্ছে থাকার পরেও শ্বশুরবাড়ির অমানুষিক আত্যাচার, অযৌক্তিক আবদার আমার পরিবার মেনে নিতে পারে নি। তাদের অপমান সহ্য করতে পারে নি। তাই তাদের পরিবারে আমাকে পাঠাতে আর রাজি হয় নি। এর কিছুদিন পর আমার পরিবার থেকে তাদের বাড়িতে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেওয়া হয় । এরপর আমার মন পুরোপুরি ভেঙ্গে যায়।
দুঃখে, কষ্টে আগের মতো কোথাও কোন শান্তি পাচ্ছিলাম না। ইচ্ছে করত এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে কিন্তু আল্লাহ্ যে নিজেকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। দুঃখে, কষ্টে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন এবং সুসংবাদ দিয়েছেন। আত্মহত্যাকারী যদি জাহান্নামি না হতো তাহলে আমাকে পৃথিবীর কোনো মায়া ধরে রাখতে পারত না। এমন সময় আসল নিজের মতো বাইরে যেতে পারসি না, মানুষদের থেকে কিভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টা ই করতাম আর নিজের মতো সময় কাটানোর জন্য ভালো লাগার কাজ গুলো করার চেষ্টা করতাম। ভালো লাগার কাজগুলোর ভিতরে কবিতা লিখা ছিল একটি। তাই নিজেই নিজেকে নিয়ে কবিতা লিখলাম---
এই যে লিলি,
তোমার পরিবারের জন্য নিজের জীবনকে করে দিলা জলাঞ্জলি।
হয়েছো তুমি ভাগ্যের করুণ বলি
তোমার নিজের মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সব কিছুকে এড়িয়ে চলি।
তোমার এমন পরিস্থিতিতে তোমাকে নিয়ে কতজন করতেছে কত দলাদলি।
তোমার নম্র, ভদ্র, অমায়িক স্বভাব দেখে তোমার এমন অবস্থার জন্য দুঃখ নিয়ে করতেছে বলাবলি।
অন্য দশজনের ন্যায় হাসি খুশি ছিল তোমার জীবন,
তোমার আচার-আচরণ, যাবতীয় গুণাবলি দ্বারা রাঙিয়ে ছিলে এই সুন্দর ভুবন।
যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে মুক্ত হয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছিলে যৌবন।
এই যে লিলি,
তোমার এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী কিছু ভুল,ধয্য না ধরা, দম্ভ, অহংকারী ভাব, মানুষকে মানুষ বলে মনে না করা,যে কোনো কিছু বাইরের অবস্থা দেখে বিচার করা, কিছু টা টাকার প্রতি লোভ।
সবচেয়ে বড় কারণ অনেকটা নিয়তিই দায়ী খুব।
জীবনের স্বাভাবিক গতিপথকে করে ফেলেছে চুপ।
কত শত, হাজার, লক্ষ, কোটি ছেলে বিমোহিত, মুগ্ধ হয়েছে দেখে তোমার ঐ রূপ,
যেই দেখে দেখতেই থাকে, ফেরাতে চাই না চোখ।
হোক না সেই, শিশু, যৌবক, পূর্ণ বয়স্ক কিংবা বৃদ্ধ লোক।
খারাপ নজরে আরো দেখে তোমার ঐ বুক।
তোমাকে পেয়ে পেতে চাই পৃথিবীর খুবই দুর্লভ জিনিস সুখ,
চাইবে না কেউ তুমি কারো হোক।
যতদিন থাকবে তোমার ঐ সৌন্দর্য, সৌন্দর্যের মহিমায় পেতে চাইবে সকল লোক।
তোমার ই সিদ্ধান্ত,সঠিক মানুষ, সঠিক জীবন সঙ্গী বেচে নিতে হবে যতই বাধা বিপত্তি আসুক।
এই যে লিলি,
যদিওবা সেই দুর্দিন চলে গেছে, করতেছ স্বাভাবিক জীবন যাপন।
করতেছ সঠিক মানুষের অপেক্ষা, কে হবে সেই সত্যিকারের আপন?
যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়,যার সাথে নির্দ্বিধায় হওয়া যায় দাফন।
সঠিক মানুষ পেলে বরণ করতেও ভালো লাগবে তোমার মোড়ানো সেই কাফন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
আমি ইয়াছিন আরাফাত
কবি,গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
উপ-দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
মোবাইল :- 01876729147
ইমেইল :- eashina404@gmail.com
0 coment rios:
দৈনিক অনুসন্ধান
সত্যের সন্ধানে বলিষ্ঠ দৈনিক অনুসন্ধান, সত্য প্রকাশে নির্ভীক...