সোমবার, এপ্রিল ০৮, ২০২৪

পড়াশোনা না করেও এখন বিকাশের একজন স্টার এজেন্ট ও নগদের সফল উদ্যোক্তা তাহিরপুরের ফয়সাল

ফয়সাল আহমেদের জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশ ঘেষা হলহলিয়া গ্রামে। সেই মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশ ঘেষা জয়বাংলা বাজারেই তিনি এখন কর্মরত। মোবাইল ব্যাংকিং যেমনঃ বিকাশ এজেন্ট, নগদ এজেন্ট, রকেট এজেন্ট, ফ্লেক্সি লোড এবং পাশাপাশি শাড়ি,লুঙ্গি, থ্রি-পিস সহ বাচ্চাদের যাবতীয় পোশাকের একটি বস্র বিতান রয়েছে তার। সম্প্রতি তিনি 'বিকাশ এজেন্ট' ব্যবসায়ী হিসাবে 'স্টার এজেন্ট' এবং 'নগদ এজেন্ট' ব্যবসায়ী হিসেবে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে সনদ অর্জন করেন। কিন্তু তার এই অর্জনে শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত জীবনের এই সময়টাতে রয়েছে নানা রকমের হৃদয় স্পর্শকাতর গল্প। যেই গল্প পড়ে বর্তমান সময়ের তরুণরা অনুপ্রেরণা পাবে, পাবে অনেক দিকনির্দেশনা। শিক্ষণীয় সেই গল্প শোনাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আজিজ ওয়েসি। 

পড়াশোনা না করেও এখন বিকাশের একজন স্টার এজেন্ট ও নগদের সফল উদ্যোক্তা তাহিরপুরের ফয়সাল 



বাবার স্বপ্ন ছিলো আলেম হিসেবে গড়ে তোলা। সেজন্য আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছিলেন। পড়াশোনায় আমি অনেক ভালো ছিলাম। আমার হাতের লেখাও অনেক সুন্দর ছিলো। সেজন্য ক্লাসের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়মিত আমার প্রসংশা করতেন। সবসময় বলতেন আমি অনেক বড় আলেম হতে পারবো। বার্ষিক পরীক্ষায়ও আমি সর্বদা প্রথম স্থান অধিকার করে মেধার পরিচয় দিতাম। পড়াশোনাও আমার অনেক ভালো লাগতো। এজন্য আমি নিয়মিত ক্লাসে যেতাম। সকাল বিকাল নিয়মিত পড়াশোনা করতাম। ক্লাসের পড়া সবসময় পরিপূর্ণভাবেই শিখতাম। এজন্য শিক্ষকও নিয়মিত আমার প্রসংশা করতেন। আর আমারও পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ বাড়তে থাকে। 

আমার পরিবার ছিলো অনেক বড় পরিবার। পরিবারে আমরা পাঁচ ভাই এবং পাঁচ বোন। বড় ভাই পরিবার থেকে আলাদা ছিলো। আর বড় বোনেরও বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। সেজন্য বাবা-মা সহ আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিলো দশ জন। আমার বাবা একজন কৃষক এবং মা একজন গৃহিণী। সেজন্য আমাদের পরিবারে আয়ের কোন উৎস ছিল না। কারণ আমি সহ আমার সকল ভাই বোন পড়াশোনায় ছিলাম। জমি থেকে আমরা যে ফসল পেতাম তা দিয়ে আমাদের ভরণপোষণ হলেও আর্থিক কোন আয় ছিল না। সেজন্য পরিবারকে অনেক কষ্টে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। তিনবেলা ভাতের অভাব না হলেও তরকারির অভাব ছিলো বড্ড বেশি। এজন্য বড় ভাই আব্দুল কাদিরকেও পড়াশোনা ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু  সাংসারিক অভাব ছিলো এক মানবেতর জীবনযাপনের মতো। বাবাও তখন বয়সে প্রায় বৃদ্ধ। তাই কাজের মানুষ নেই বললেই চলতো। 

এমন পরিস্থিতিে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমরা বাকি তিন ভাইয়ের মধ্যে একজনকে পড়াশোনা ছাড়তে হবে। পড়াশোনা ছাড়তে বলার কারণ আয় রোজগার করা। কারণ পরিবারের সদস্যরা তখন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করছিলো। তাই বাবা যখন আমাকে বললেন পড়াশোনা ছাড়ার জন্য আমি বাবার কথার অবাধ্য হতে পারলাম না। আমি পড়াশোনা ছেড়ে দিলাম। কারণ আমি নিজ চোখে পারিবারিক অবস্থা দেখছিলাম। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে ছিলাম। তারপর পড়াশোনা ছেড়ে আমি কাজ করে আয় রোজগার করার জন্য মনোযোগ দিলাম। শুরুতে আমি যেহেতু বয়সে ছোট ছিলাম তাই আমি সঙ্গী খোঁজে নিলাম। যার কাজের প্রতি নেশা আছে। সেই সঙ্গীকে নিয়ে গ্রামের পাশের নদীতে বর্ষাকালে মাছ ধরে, সেই মাছ বাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। মাছ বিক্রির টাকা এনে মায়ের কাছে দিতাম। সেই টাকা দিয়ে তরিতরকারি কেনা হতো। এভাবেই যাত্রাটা শুরু। 


কিন্তু যখন বর্ষার মৌসুম শেষ হয়ে গেলো তখন মাছ ধরার সুযোগও বন্ধ হয়ে গেলো। তাই আমি ভিন্ন কাজের সন্ধান করি। পড়াশোনার প্রতি যেমন আমার অনীহা ছিল না, কাজের প্রতিও আমি সেরকমই ছিলাম। যেহেতু আমার বাড়ি মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে তাই সেখানে কাজেরও অভাব ছিলো না। কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশে কয়লা আমদানি করা হতো এখান দিয়ে। যাঁরা কয়লা আমদানিকারক ছিলো তাদের বিভিন্ন কর্মী প্রয়োজন হতো। কারণ ট্রাকে করে কয়লা আসতো বাংলাদেশে। সেই কয়লা আবার নৌকাযোগে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জয়গায় রপ্তানি করা হতো। সেজন্য কয়লা আমদানি রপ্তানি ইত্যাদি কাজের জন্য বিভিন্ন কর্মী প্রয়োজন হতো। আমার বন্ধুদের সাথে আমিও সেই কাজে অংশ নিতাম। ৩০০ টাকার বিনিময়ে সারাদিন হাজিরা দিতাম। সারাদিন হাজিরা দেওয়ার জন্য ভোর পাঁচটায় বের হতে হতো। আবার বাসায় আসতে সন্ধ্যা সাতটা, আটটা বা কখনো কখনো রাত নয়টাও বেজে যেতো। এভাবেই চললো কিছুকাল। 

আবার কোনো কোনো দিন এই তিনশত টাকার বিনিময়ে সারাদিন হাজিরা দেওয়ার কাজটিও পেতাম না। তখন বিভিন্ন কয়লা আমদানিকারক মালিকের ডিপোর পাশে গিয়ে কাজ খোঁজতাম। কখনো পেতাম কখনো পেতাম না। মাঝে মাঝে ভারতের বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে গিয়েও কাজ করেছিলাম। এই কাজটি করতাম যেদিন বর্ডার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকতো সেদিন। এভাবে কাজ পেলে করতাম। না পেলে ফিরে আসতাম। বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কখনো কাজ করার জন্য অবহেলা করিনি। কাজ না পেলেও হাল ছাড়িনি। পরের দিন আবার বের হতাম। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই কাজ পেতাম। দিনশেষে যে টাকা পেতাম তা এনে মায়ের কাছে দিতাম। 


পারিবারিক পরিস্থিতি আর আমার কাজে যাওয়া, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয় তখন আমাকে ধীরে ধীরে ভাবাতে শুরু করলো। আমি তখন জীবনের মানে বুঝতে শুরু করলাম। বুঝতে শুরু করলাম জীবন কোনো পুষ্পশয্যা নয়। জীবন এক যুদ্ধের নাম। এই যুদ্ধ সেই যুদ্ধ নয়। এই যুদ্ধ হলো কাজ করে পরিবারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটানো। তাই যত কষ্টই হতো প্রতিদিন কিছু না কিছু টাকা উপার্জন করার চেষ্টা করতাম। এভাবে কাজ করে উপার্জন করে আল্লাহর রহমতে কিছু আয় হলে বাবা আমাকে একটা ফল বিক্রির দোকান করে দেয়। প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাদাঘাট বাজার। সেখান থেকে পায়ে হেটে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার ফল যেমন আপেল, আঙ্গুর ইত্যাদি কিনে এনে জয় বাংলা বাজারে আমি বিক্রি করতাম। এভাবে ফল বিক্রি করে অনেক দিন পার করি। এই জয়বাংলা বাজারে আবার আমার বড় ভাইয়ের (যিনি পরিবার থেকে আলাদা ছিলো) একটি বস্র বিতান ছিলো। হঠাৎ তার দোকানে একজন কর্মচারী প্রয়োজন হলো। সেই সুবাদে তিনি আমাকে নিতে আগ্রহী হয়ে বাবার কাছে বললেন। বাবাও রাজি হলো। তখন থেকে আমার জীবন একটা নতুন মাত্রা নিতে শুরু করে। 

আমি প্রথমে বস্র বিতান পরিচালনা করার জন্য সকল নিয়ম কানুন শিখে নেই। বেচা কেনা সম্পর্কেও শিখতে শুরু করি। এই শিক্ষাটা আমার জন্য একটা প্রশিক্ষণের মতো ছিলো। যেখানে প্রশিক্ষক আমার বড় ভাই। তবে এটা শিখতে আমার খুব বেশি সময় লাগে নি। কারণ আমি প্রথমত কাজের প্রতি অবহেলা করিনি। দ্বিতীয়তো ফলের ব্যবসা থেকে হিসাবের ব্যাপারেও ছিলাম সতর্ক। কাস্টমারের সাথে দরকষাকষিও করতে পারি ভালো। সবকিছু মিলিয়ে ছয় মাসের মধ্যে ট্রেইনিং শেষ হয়ে যায়। এই ট্রেইনিংয়ে শুধু পোশাক কেনা বেচা করাই শিখিনি, শিখেছি বিকাশ,নগদ,রকেট এজেন্ট পরিচালনা করাটাও। আমার বড় ভাই তখন আমাকে বাৎসরিক বেতন ভুক্ত হিসাবে চুক্তি করে ফেলেন। বাবার সাথে করা সেই চুক্তি অনুযায়ী শুরুতে আমি ৩৬০০০ টাকা বেতনে বাৎসরিক কর্মচারী ছিলাম। চার বছর পর তা ৫০০০০ টাকায় উন্নীত হয়। এভাবে ছয় বছর কর্মচারী হিসেবে কাজ করার পর আমার মনে হলো, এখন আমি নিজেই একটা বিজনেস পরিচালনা করতে সক্ষম হবো।  


তারপর বাবা মায়ের সাথে পরামর্শ করে বড় ভাইয়ের দোকানের পাশেই একটা বস্র বিতান দেই। যেখানে শাড়ি, লুঙ্গি, শার্ট, প্যান্ট, থ্রি পিস সহ বাচ্চাদের যাবতীয় পোশাকের ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি বিকাশ এজেন্ট, নগদ এজেন্ট, রকেট এজেন্টে লেনদেন শুরু করি। ধীরে ধীরে আমার আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। আমি নিজেই ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকি। এভাবে চার বছর ব্যবসা পরিচালনা করার পর 'বিকাশ' থেকে আমাকে উপজেলার অন্যতম 'স্টার এজেন্ট' বা 'এজেন্ট তারকা' এবং 'নগদ' থেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে মনোনীত করে সনদ প্রদান করেছেন। এতে আমি অনেক আনন্দিত। বিকাশ ও নগদে প্রতি আমি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। মহান আল্লাহ'র নিকট আমি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। কারণ এখন আমি আমার বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হয়ছি। আল্লাহর রহমতে আমার পরিবারে এখন আর কোনো অভাবের অভিযোগ নেই। আমি এখন ভাই বোনদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে সক্ষম হয়েছি। আল্লাহর রহমতে এখন আমি সুখী। কারণ এখন আমি একজন উদ্যোক্তা। 

তরুণ যারা পড়াশোনা করেনি কিন্তু এখনো বেকার তাদের উদ্দেশ্যে আপনার কী বক্তব্য? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি মনে করি সেই যেই হোক বসে না থেকে কাজে লেগে পড়া। কাজ করতে করতেই অভিজ্ঞতা অর্জন হবে। কাজে নেমে পড়লেই নতুন কাজের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই অবহেলা না করে কাজের খোঁজে ঘর থেকে বের হতে হবে। কাজের কোনো অভাব নেই। তাই অবহেলায় জীবন অতিবাহিত না করে কাজে নেমে পড়লে একদিন না একদিন সফলতা আসবেই, আসবে। 

লেখকঃ আজিজ ওয়েসি 
শিক্ষার্থীঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইলঃ azizquadery1234@gmail.com


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios:

দৈনিক অনুসন্ধান
সত্যের সন্ধানে বলিষ্ঠ দৈনিক অনুসন্ধান, সত্য প্রকাশে নির্ভীক...